আধুনিক মুসলিম বিশ্বের বিনির্মাণ
পর্ব-৩
এর অর্থ এই নয় যে, উপনিবেশবাদের আগমনের পূর্বে মুসলিম বিশ্বে জাতিগত সংহতি এবং জাতীয়তাভিত্তিক পরিচিতির ধারণা অনুপস্থিত ছিল। এই ধরণের অনুভূতিগুলো সবসময় শক্তিশালীই ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইরানিরা প্রথম থেকেই নিজেদেরকে আরব ও তুর্কিদের থেকে আলাদা হিসেবে দেখতো এবং শিয়াবাদ ইরানে অনেকভাবে নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছিলো, যা তাদের চারপাশের সুন্নি তুর্কি, আরব ও তুর্কমেনিয়ানদের থেকে ইরানীদের আলাদা করে। আরব এবং বেদুইন, আরব ও তুর্কী, বা মালায় ও জাভানিসদের মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান আছে। জাতিগত জাতীয়তাবাদ এবং একটি জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্য নতুন ধারণা এবং ঔপনিবেশিক যুগেই তার সৃষ্টি হয়েছে। তখনই রাজনৈতিক পরিচিতির ধারণা হিসেবে জাতীয়তাবাদ মূখ্য হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম রাজনৈতিক চেতনায় এর শেকড় গেড়েছিল এবং এর অংশ হয়ে উঠেছিল যা ইসলামিক পরিচয়কেও সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়ে যায় এবং পশ্চিমাদের আদলে এটি রাষ্ট্রীয় সীমানায় আবদ্ধ হয়।
এজন্য জাতীয়তাবাদি রাজনৈতিক আদর্শকে ঘিরে নির্মিত জাতিরাষ্ট্রের ধারণা যা তুলনামুলকভাবে সাম্প্রতিক এবং ইসলামের উম্মাহ্র ধারণা যা মুসলিম রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন দেয়- এই দুয়ের মাঝে মুসলিম বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। উম্মাহর ধারণা শুধু মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধই করে না, বরং তাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক অঙ্গীকারের চেয়ে ইসলামকে প্রাধান্য দেয়। রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের মধ্যে এই সমস্যাটির তীব্রতা রাষ্ট্র কতটুকু ইসলামী চেতনাকে গ্রহন করতে ইচ্ছুক তার উপর নির্ভর করে। যেখানে সৌদি আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া জাতীয়তা এবং উম্মাহর ধারণার মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে চেয়েছ সেখানে তুরস্ক, পাহলভি ইরান, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের দাবিকে সচেতনভাবে উম্মাহর উপর প্রাধান্য দিয়েছে। এখানে জাতীয়তাবাদের চেতনা কতটা শক্তিশালী সেটিও গুরত্বপূর্ণ। তুরস্ক, ইরান এবং মিশরের মতো শক্ত জাতীয়তাবাদের চেতনাসমৃদ্ধ দেশগুলো জোরালোভাবে তার বিশেষাধিকারগুলি তুলে ধরেছে, যেমনটা মালয়েশিয়া বা নাইজেরিয়ার মতো বিশাল সংখ্যালঘুদের দেশগুলোতেও রয়েছে। বিপরীতদিকে, পাকিস্তানের মতো দুর্বল জাতীয় চেতনার অঞ্চলগুলিতে উম্মাহর আদর্শ প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছে।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলি স্বাধীনতা লাভ করেছিল যার সীমানা উপনিবেশিক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। তারা মোটাদাগে রাষ্ট্রগুলি যেভাবে জন্ম নিয়েছিল সে ভৌগলিক আকার এবং রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা নির্ধারিত হয়ে স্বতন্ত্র্য সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে তা মেনে নিয়েছিল। যদিও সীমানার সম্প্রসারণ ঘটেছে: যেমন মরোক্কো কর্তৃক পশ্চিম সাহারা, ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর, তুরস্ক কর্তৃক উত্তর সাইপ্রাস দাবি ও ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইরানের বাহরাইন, সিরিয়ার লেবানন এবং ইরাকের কুয়েত দাবির মত কিছু উদাহরণ রয়েছে। এই দাবিগুলি সামনে আনা হয়েছে জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের নামে। এগুলো সঙ্গায়িত হয়েছে ও বৈধতাও পেয়েছে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে। ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের দ্বারা নির্ধারিত ইসলামিক সাম্রাজ্য বা মুসলিম বিশ্বের অঞ্চলসমূহের বিভক্তিকে বা নতুন সীমানা নির্ধারণ করার নিয়মগুলোকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো সামগ্রিকভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি। মুসলিম দেশগুলি উম্মাহ পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেনি, বরং কেবল জাতিরাষ্ট্রের সীমানা প্রসারিত করতে চেয়েছে। ঐসব সীমান্তের বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যদিও সীমান্তের পরিধি নিয়ে মাঝে মাঝে আপত্তি এসেছে।
ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:

No comments: