আধুনিক মুসলিম বিশ্বের বিনির্মাণ
পর্ব-৫
এর ফলস্বরূপ, মুসলিম অঞ্চলের উপনিবেশিক ভাগ, নীতিগতভাবে এবং যেকারণে সেগুলো প্রাথমিকভাবে শুরু করা হয়েছিল তা পরবর্তী মুসলিম রাষ্ট্রগুলির দ্বারা গৃহীত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়ও মেনে নেয়া হয়েছে। যদিও এখানে ঔপনিবেশিকতার ধারা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না বলা যাবে না। প্রথমত, অনেক বিভক্তিই ছিল সমস্যাপূর্ণ। কোন কোন বিভক্তি শুধু স্থানীয় ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের কথা বিবেচনা করে করা হয়েছিল, জনগণ ও সম্পদের উপর তার প্রভাব কি হবে সে কথা চিন্তা করা হয়নি। অন্য বিভক্তিগুলো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনা দূর করার জন্য করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকরা ইউরোপীয় মিত্রকে সন্তুষ্ট করার জন্য বা দখলদার মনোভাবের রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে বাফার হিসাবে কাজ করার জন্য উপনিবেশগুলি তৈরি করা হয়েছে। উসমানী খেলাফতকে ভাঙ্গার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিকল্পনা ফ্রান্স, ইতালি, এবং গ্রীসকে শান্ত করার জন্য করা হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতকে রাশিয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনে আফগানিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। ১৭৯৮ সালের পর ফ্রান্সের ব্যাপারে একই ধরনের উদ্বেগের কারণে মিশর দখল করে ব্রিটেন, যার ফলস্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ অবশেষে নতুন ঔপনিবেশিক অঞ্চল সৃষ্টি করে, যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পারস্য উপসাগরীয় তেলের ব্যাপারে ব্রিটিশ স্বার্থের কারণে কুয়েতের সৃষ্টি হয় এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরানের খুজাস্তান প্রদেশ থেকে "আরবিস্থান" তৈরির অনুরূপ একটি প্রচেষ্টা চালানো হয়। কয়েক দশক পরে, একইরকম অর্থনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে ব্রিটেন ব্রুনাইকে মালয়েশিয়ায় যোগ না দিতে উৎসাহিত করে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিবেচনাগুলি আরও বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। ফ্রান্স সিরিয়ার ভেতর থেকে লেবানন সৃষ্টি করে একটা খ্রিস্টান-আরব রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে; এবং আমির আব্দুল্লাহকে সমর্থন দিতে ব্রিটেন গঠন করে জর্ডান, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন এবং যার পরিবার উসমানীয় সাম্রাজ্যের আরব ভূমিগুলোকে ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে বিভক্ত করার ফলে প্রতারিতবোধ করত।
উপনিবেশবাদ আসলে কীভাবে কাজ করেছে এবং এর ছাপ কি ছিল তা মুসলমানদের নিজেদের পরিচয়ের ধারণা ও রাজনীতির ধারণাকে নির্মাণ করেছে এবং বিভিন্ন মুসলমান রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা লাভের পর ভিন্ন ভিন্ন পথে ধাবিত করেছে। শুরুর দিকে, ঔপনিবেশিক শাসকরা যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে ইউরোপীয় ভাষায় প্রশিক্ষিত করেছিল তাদের মাধ্যমে এবং সরকার গঠনের বিভিন্ন উপায়গুলোর মাধ্যমে মুসলিম অঞ্চলসমূহের বিভক্তিগুলো ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়। তাদের মগজ যখন উচ্চবিত্তরা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল এবং তাদের সামনে সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাগুলো পরিষ্কার হয়ে উঠল, তখন সীমান্ত সৃষ্টির ব্যাপারে দৃঢ়তা সৃষ্টি হলো। বিদ্যমান জাতিগত পরিচয়গুলিকে ঘিরেই এই দৃঢ়তা গড়ে উঠে ও জাতীয়তাবাদের ভিশন তৈরী হয় যা ঐ সীমানাগুলিকে আরও বেশি অর্থবহ করে তোলে। একজন সরকারী আমলা কুয়ালালামপুরে বা দামেস্কের "মালয়শীয়" বা "সিরিয়" চিন্তার প্রতি নিজের স্বার্থের কারণের আগ্রহ প্রকাশ করে যাতে বৃহত্তর মালয় বা আরব সত্ত্বার প্রেক্ষিতে তার ক্ষমতা প্রাদেশিক অফিসারের মত সীমিত না থাকে। এটা এমন এক অনুভূতি ছিল যে পরবর্তীকালে ১৯৫৮-৬১ সালের মিশরীয়-সিরীয় ঐক্য চুক্তিও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ইরাকি ও সিরিয়ান আমলাতান্ত্রিকরা, যারা উসমানী খিলাফতের অধীনে একই পরিশীলিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক আদর্শ নিয়ে কাজ করত, তারা তখন বিভিন্ন ইউরোপীয় ঐতিহ্য ও ভাষাগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলল যা তাদের "বিচ্ছিন্নতা"কে চূড়ান্ত করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এইভাবে সার্বজনীন বৈশ্বিক একাত্বতার বদলে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকেই শক্তিশালী করে তুলছিলো। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা এবং নয়া এলিটদের জন্য যে কাজের ক্ষেত্র এটি সৃষ্টি করেছিল, পরিশেষে সেগুলোই রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে যার অস্তিত্ব আগে ছিল না।
ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:

No comments: