!!!! ___নীরব নদীর এই কান্না___!!!!
আশির দশক—একটি সময়, যখন প্রতিটি ভোর ছিল পাখির কলতানে মুখরিত আর প্রতিটি বিকেল ছিল মাঠে খেলাধুলায় পূর্ণ। কাঁচা রাস্তাগুলো, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা খাল, আর সবুজে মোড়া প্রকৃতি ছিল আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বৈশাখ মাসের শেষদিক মানেই খাল ছাপিয়ে পানি, শিশুরা ডুবে যেত আনন্দে আর প্রকৃতি যেন নিজেই সজীব হতো আমাদের খুশিতে।
১৯৮৮ সাল, ২৯শে মে, রবিবার। সময়টা ছিল দুপুর ২টা ৩০ মিনিট। আমাদের বাড়ির পেছনে আড়িয়াল-খাঁ নদী। সেই নদীর বুকে ভেসে এলো একটি লঞ্চ, নোঙর করল ধীরে। লঞ্চে প্রায় ১০০ যাত্রী। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শির ভালোবাসায় ভরা এক যাত্রা শুরু হলো আমার জীবনে—পালকিতে বসে একজন নববধূ হিসেবে নতুন ঠিকানার পথে পা বাড়ালাম।
আমার শ্বশুর আব্বা, স্বামী, পাঁচ দেবর, আরও অনেক অচেনা পরিচিত মুখ—সবাই মিলে যেন এক বিশাল পরিবার। সেই নদী, সেই লঞ্চ, সেই ইসলামী সংগীত আজও যেন কানে বাজে। সেদিনের আনন্দে যেমন ছিল অপার ভালোবাসা, তেমনি ছিল একরাশ স্বপ্ন।
কিন্তু আজ ২০২৫ সাল। এই দীর্ঘ ৩৬ বছরের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে আমার মা-বাবা, শশুর-শাশুরি, চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফি, এবং আরও অনেকে—যাদের অফুরন্ত দোয়ায় শুরু হয়েছিল আমাদের নতুন জীবন। আজ সেই খাল আর নেই, মরে গেছে নদী, হারিয়ে গেছে সেই নদীর বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো। প্রকৃতি আজ নির্জীব, প্রাণহীন, নিঃসাড়।
_____
আমরা ছোটবেলায় উঠানে বউছি, কানামাছি, গোল্লাছুট—আরো কত শত খেলা খেলতাম। বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরা একসাথে জড়ো হতাম উঠানে, খেলা জমে উঠত বিকেল পর্যন্ত। আমাদের খেলার দর্শক থাকতেন মা-চাচিরা, ভাবিরা। সেই হাসির শব্দ, সেই নিস্পাপ কোলাহল আজও যেন কানে বাজে।
আমাদের ভাইয়েরা আবার আমাদের খেলার সাথী হতেন না, তারা খেলত ভিন্ন রকম খেলা—দাঁড়িবান্দা, হাডুডু। তাদের খেলার মাঠ ছিল ভিন্ন। সেই দূরত্বের মধ্যেই ছিল শালীনতা, সম্মান আর এক সামাজিক শৃঙ্খলা।
বাড়িতে কোন ছেলে মেহমান আসলে, আমরা সামনে যেতাম না, লজ্জা বোধ করতাম। সেজন্য মা-চাচিদের কাছে অনেক সময় বকাও খেতে হতো। কিন্তু আব্বা বলতেন, “থাক, না যাওয়াই ভালো। লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।”
মাগরিবের নামাজের পর আব্বা মাঝে মাঝে রেডিও চালাতেন, খবর শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু খবর শেষ হলেই যখন শুরু হতো বাজনার আওয়াজের সাথে গান—তখনই আব্বা বলে উঠতেন, “হারাম, হারাম! বন্ধ করো।” আমরা দুই বোন গান শোনার অপেক্ষায় থাকতাম ঠিকই, কিন্তু আব্বার কণ্ঠে সেই নিষেধাজ্ঞা শুনেই এক দৌড়ে রেডিও বন্ধ করে দিতাম। বিনা বাক্যে, বিনা প্রশ্নে—কারণ আমরা আব্বাকে খুব ভয় পেতাম, আবার ততটাই শ্রদ্ধা করতাম। এখন ভাবলে অবাক হই—কতটা অনুগত ছিলাম আমরা!
আজ সেই বাবা-মা চলে গেছেন, বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। খাল মরে গেছে, নদীটা হয়েছে স্রোতীন। প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে প্রাণহীন। যেখানে প্রান নেই, সৌন্দর্য নেই, সভ্যতা নেই, নেই কোরআনের পরিপূর্ণ কোন শিক্ষা। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের, সমাজের অবক্ষয় হয়েছে।
আগের তুলনায় ওয়াজ নসিহা, তালিম তোরবিয়াত অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত জীবন দিন দিন কলুষিত হচ্ছে, হচ্ছে নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়। সমাজের যেসব ব্যক্তি-গোষ্ঠী দিনের তালিম দিয়ে যাচ্ছেন, হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী কথা ছিল তাদের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় - বেশি সংখ্যক দিনের দাঈ আজ নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন সুন্নাত ও বেদাতের মিশ্রণ করে ফেলেছেন।
৮০ এবং ৯০ এর দশকে বিয়েতে গায়ে হলুদ নামের এই বিষাক্ত ব্যাধি এত বিস্তার লাভ করেনি। সমাজে প্রচলিত হলুদ অনুষ্ঠানে একটা যুবক ছেলেকে তার ভাবি এবং মামাতো, ফুফাতো ও প্রতিবেশী বোনেরা হলুদ দেয়ার মাধ্যমে যে বেহায়াপনার উদাহরণ পেশ করে তা মুসলিম জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সমাজে প্রচলিত এই বেদাতকে কঠিনভাবে আমাদের দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন "হে নবী, আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে চলে। আর লজ্জা স্থানের হেফাজত করে। এটাই হবে তাদের পবিত্র আচরণের অবলম্বন; আল্লাহ তাদের সকল কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবগত" (- সূরা আন নুর আয়াত ৩০।)
অনুরূপভাবে মুমিন নারীদের উদ্দেশ্যেও বলা হয়েছে "হে নবী! মুমিন নারীদেরকেও বলে দিন তারাও যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে চলে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তাদের সৌন্দর্যের প্রকাশ না ঘটায়, তবে যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে মাথা থেকে বুক পর্যন্ত আবৃত করে রাখে।" (সূরা আন নূর আয়াত ৩১।)
এভাবে নারী পুরুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার জন্য যে হিজাবের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা একটি সমাজ এবং ব্যক্তির পবিত্রতার জন্য একান্ত অপরিহার্য।
আমরা যারা সিরাতুন্নবী উদযাপন করতাম, রাসূলের জীবনী পড়তাম, হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম—আজ আমাদের সন্তানরা ব্যস্ত জন্মদিন উদযাপনে, ব্যস্ত লোক দেখানো আনন্দে। রাসূল (সা.) এর জীবনী নিয়ে নেই আগ্রহ, নেই গবেষণা। কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে নসিহা করলে-বলছে, -"আমরা তো ওই দিন করছি না, অন্যদিন একটু আনন্দ করছি।”
হ্যাঁ, সেখানেই হইচই হচ্ছে, উপহার সামগ্রী দেয়া হচ্ছে-তারপর বলবে আমরা তো ঐদিন করছি না। এভাবেই কুরআনে বর্ণিত শনিবার ওয়ালারা ধ্বংস হয়েছিল।
আজ এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ৫৪ বছর বয়সে আমার মনে হয় - এই তো সেদিন ওই লঞ্চে একশত যাত্রী সাথে পালকিতে চড়ে, কত সম্মানের সাথে, কত মায়া-মমতা দিয়ে, কত আদরে জড়িয়ে আমার শ্বশুর আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন বড় ছেলের বউ করে। এখনো যেন সেই লঞ্চের শব্দ, মাইকে বাজানো ইসলামী সংগীত এর সুর, আমার কানে বাজছে।
অথচ আমরা পারিনি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে, পারিনি একটা দিন্বী পরিবেশ তৈরি করতে। আগামী দিন যেন হয় কুরআনী হেদায়াত লাভের, আমাদের আগামীকাল যেন হয় বেদআত দূরীকরণের, আগামী সূর্যদয় যেন নিয়ে আসে সুন্নতে পরিপূর্ণ জীবন।
হে প্রভু আমাদের সন্তানগুলো করে দিন সদগায়ে জারিয়া, কবুল করুন আমাদের বাবা-মায়ের সমস্ত চেষ্টা প্রচেষ্টা।
আমিন।
লেখিকা
-রোকেয়া বেগম

No comments: