আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র
পর্ব-১
বর্তমানে পশ্চিমের অ্যাটলাস পর্বতমালা থেকে প্রাচ্যের মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং আফ্রিকার মরূভূমি থেকে মধ্য এশিয়ার সমতলভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত পঞ্চাশের অধিক মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেমন ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো বিশ্বের কিছু জনবহুল দেশ অন্তর্ভুক্ত, আবার মালদ্বীপ এবং কমোরোসের মতো কিছু অল্প জনসংখ্যার দেশও রয়েছে। কিছু কিছু দেশ শক্তিশালী ও সেখানে কার্যকর একটি সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মতো কিছু দেশ প্রতিনিয়ত নিজেদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। মালি এবং বাংলাদেশের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রও যেমন রয়েছে আবার লিবিয়া, ব্রুনাই, তুর্কমেনিস্তান এবং সৌদি আরবের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে প্রাচূর্যময় দেশও রয়েছে। তবুও মালয়েশিয়া, যেটি ১৯৯৭ সালে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, তাদের সম্পদের উৎস ছিলো সফল শিল্পায়ন। কিছু মুসলিম রাষ্ট্র জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যহীন; অন্যদের মধ্যে আবার জাতি, ভাষা, বা ধর্মীয় দিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিদ্যমান। সামাজিক, অর্থনৈতিক, মতাদর্শিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক মতামতের প্রায় সব বৈচিত্র্যই এই রাষ্ট্রগুলোতে উপস্থিত। ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র থেকে আরব বিশ্ব বা ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া (যেখানে প্রদেশগুলিতে রাজতন্ত্র শাসন চালায়) ও আরব বিশ্বের রাজতন্ত্র এবং ব্রুনাই থেকে তুরস্ক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় মতো গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক আদর্শ ও সরকার পরিচালনায় ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে।
এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতিতে কিছু সাদৃশ্যও বিদ্যমান। ইসলাম তন্মধ্যে সর্বাধিক সুস্পষ্ট, এবং তা কেবল একটি ধর্ম বা বিশ্বাস হিসাবে নয়, বরং একটি আত্ম-পরিচয়ের উৎস এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে হাজির। ইসলাম দীর্ঘকাল ধরেই মুসলিম রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সাব সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যকে উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি সংগ্রামের লড়াইয়ে ইসলাম ভূমিকা পালন করেছে। ঔপনিবেশিক যুগের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামী যোদ্ধা, চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক নেতারা মুসলমানদের রাজনৈতিক কাঠামো গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। উপনিবেশবাদ থেকে মুসলিম দেশগুলোর মুক্তিকে ইসলামী আন্দোলন হিসেবেই তুলে ধরা হয়, যেমন, ১৮২৬ সালে ভারতে সৈয়দ আহমেদ শহীদের (১৭৮৬-১৮৩১) উত্থান থেকে ইরানে মির্জা হাসান সিরাজীর (১৮১৫-১৮৯৪) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং শাইখ ফাজলুল্লাহ নুরী (১৮৪৩-১৯০৯) বা মধ্য এশিয়ার ইমাম শামিল (১৭৯৬-১৮৭১), আলজেরিয়ার আমির আব্দুল কাদের (১৮০৩-৮৩), সোমালিল্যান্ডের মুহাম্মদ ইবনে আবদিল হাসান (১৮৬৪-১৯২০), সুদানের মাহদি (মৃত্যু ১৮৮৫), ইরানের জামাল আল-দ্বীন আল-আফগানি (১৮৩৮-৮৭), বা ১৭৮০ ও ১৮৮০-এর দশকে পশ্চিম আফ্রিকায় তিজানি জিহাদ (উসমান দান ফোদিও [১৭৫৪ – ১৮১৭] এর সোকোটো খিলাফত এবং আল-হাজ্ব উমার আল ফাতা টোরোর বিদ্রোহ [১৭৯৪-১৮৬৪])। অন্যান্য "ইসলামী" আন্দোলনগুলির মধ্যে মালয়দের হিজবুল ইসলাম (ইসলামিক পার্টি), ভারতের জমিয়ত-ই উলামা-ই হিন্দ (উলামা পার্টি), ১৯২০ এর দশকে ইরানের শিয়া উলেমা, লিবিয়ার সানুসিয়াহ (উমর মুখতার পরিচালিত, ১৮৫৮-১৯৩১) কিংবা মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড অন্তর্ভুক্ত। ঔপনিবেশিক আমলে বিভিন্ন ইসলামী বুদ্ধিজীবি যাদের সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে রয়েছেন মুহম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮), আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) এবং ভারতের ও ভারতভাগ পরবর্তী পাকিস্তানের মওলানা হোসেন আহমদ মাদানী (১৮৭৯-১৯৫৭) এবং মাওলানা আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-৭৯) প্রমুখ। এসব আন্দোলন এবং আন্দোলনের চিন্তাবিদগণ ঔপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে স্থানীয়দের নিয়ে সংগঠিত করার ব্যাপারে অগ্রগামী ছিলেন। তারা ঔপনিবেশিকতা বিরোধিতাকে জিহাদের ভাষায় বর্ণনা করেছেন, ইসলামের মুক্তি সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন – যা আজও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সংগ্রামের পথে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে, যেমন সাম্প্রতিককালে ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ এবং ১৯৯৬ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চেচনিয়ার মুক্তিযুদ্ধে তা ভূমিকা রেখেছে। এই ইসলামী আন্দোলনগুলো পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী জাগরণের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় মাসজুমি আন্দোলন (মজলিস সিয়োরো মুসলিমিন ইন্দোনেশিয়া, মুসলমানদের পরামর্শমূলক বা শুরা কাউন্সিল) ইন্দোনেশিয়ার উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম এবং ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্র গঠনের শুরুর দিকে ভূমিকা রেখেছিল।
পরবর্তীতে; ইসলাম ঐসব রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্যকে প্রভাবিত করেছে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইসলামী আন্দোলন সেসব রাজনীতির প্রকৃতিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে এবং রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানিয়েছে। চলমান রাজনীতিতে ইসলামের গুরুত্ব, বিশেষত ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এর প্রাসঙ্গিকতার কারণে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র গঠন এবং ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশ পরবর্তী যুগের সাথে এর সম্পর্ক জটিল এবং মাঝে মাঝে সমস্যাপূর্ণ হয়েছে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা মুসলিম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই দেখা যায় তা হলো, রাষ্ট্রগুলি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এবং অধিকাংশ রাষ্ট্রই বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং তাদের সমাজের অগ্রগতি ও শিল্পোন্নয়ন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এভাবে, এসব রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ঐতিহ্যগত ধারা, সাংস্কৃতিক আবহ এবং তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের পথে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো রয়েছে তার সাদৃশ্য রয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো তাদের সামনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ভিন্নভাবে মোকাবিলা করে, ঠিক যেমন আকার, ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক অবস্থানও তাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধারা এনেছে।
উপনিবেশবাদের ইতিহাস মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে বৈচিত্র্য এবং রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন পরীক্ষার মিলগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের মতো জাতিগত পরিচয়, সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলি এবং অন্যান্য আদিবাসী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো যেমন মুসলিম বিশ্বের মিলগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে, তেমনি বিপরীতে অর্থনীতি, মতাদর্শ এবং নেতৃত্ব এসব দেশের অমিলগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে। উপনিবেশবাদও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগঠনের যে অভিজ্ঞতা তার মিল ও অমিলগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে। ব্রিটিশ ও ফরাসিরা আফ্রিকা, এশিয়া এবং আরব অঞ্চলের বিরাট অংশ শাসন করেছে। ডাচ শাসিত অঞ্চলগুলি বর্তমানের ইন্দোনেশিয়ায়, অবস্থিত। আর জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং রাশিয়ানরা পূর্ব আফ্রিকা, ফিলিপাইন, মালায়া (এখন মালয়েশিয়া নামে পরিচিত), ককেশাস অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ার মুসলমান অঞ্চলগুলি দখল করেছিল। পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ মুসলিম ভূখণ্ডের শেষ ও একমাত্র চলমান ঔপনিবেশিক সম্পর্ক হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদিও উপনিবেশবাদের সংজ্ঞাগত বৈশিষ্ট্যগুলি দিয়েই এই সকল অঞ্চলগুলো শাসন করা হয়েছে, তথাপি ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ তাদের ঔপনিবেশিক লক্ষ্যগুলো কিভাবে অর্জন করেছে, বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়েছে তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যেমনি মৌলিক সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি নিজস্বতাও রয়েছে এবং তার শিকড় তাদের ইতিহাস, বিশেষ করে সেই ঔপনিবেশিক অঞ্চলের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এই অধ্যায়ে বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম রাজ্যের উন্নয়নের সাথে ঔপনিবেশিকতার সম্পর্ককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কীভাবে ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার ফলে প্রায় একই ধরণের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, আবার ঔপনিবেশিকতার সাথে প্রতিটি রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতাগুলির কারণে তাদের উন্নয়নে কীভাবে পার্থক্যও ঘটেছে তারও বর্ণনা এসেছে। ঔপনিবেশিক সময়কাল ছিল এক শতাব্দীরও কম, অথচ তা সেইসব শাসিত অঞ্চলের ভূগোল, অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক এবং রাজনীতির সব দিকই চিরতরে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান।
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:
Reviewed by pencil71
on
August 21, 2019
Rating:

No comments: