Technology

test

বাবাদের সংগ্রাম || মু. বিল্লাল হোসেন




রসূলপুর গ্রামের মধ্য বয়স্ক বাসিন্দা বাদশা মিয়া। নিজের নাম বাদশা হলেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবনে সুখ কি জিনিস সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি কোনদিন। আমাদের সমাজে এরকম কিছু নাম রাখে বাস্তবের সাথে মোটেও মিল নেই। যেমন সুলতান, যুবরাজ, বাদশা, রাজা রাণী, সুলতানা ইত্যাদি। জামিলা অর্থ সুন্দরী, কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে কালো মেয়ের নাম রাখা হয় জামিলা। আবার কেউ কানা ছেলের নাম রাখে পদ্মলেচন, যার অর্থ পদ্মের ন্যায় চক্ষু যার। আবার কেউ যুদ্ধ না করে, জীবন বলি না দিয়েও শহিদ নাম রাখে। ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ না করে, মৃত্যুবরণ না করে শহিদ কিভাবে হয়? আমার বুঝে আসে না।

তিন কন্যা ও এক ছেলের পিতা বাদশা মিয়া। বড় মেয়ে কাজলকে পাশের গ্রামে আবুল বয়াতির ছেলে রিপনের সাথে বিয়ে দিয়েছেন বছর তিনেক আগে। আবুল বয়াতি গরিব হলেও লোক ভালো, বাদশা মিয়ার কাছ থেকে এক টাকাও যৌতুক নেননি। কাজল রিপন দম্পত্তির ছয় মাস বয়সি ছেলের নাম ফাহিম। মেঝো মেয়ে লিপি গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ে। মেধা ভালো দেখে, টিচারার বাদশা মিয়াকে বলে লিপিকে পড়াশোনা করাইতে হবে প্রয়োজনে আমরা স্কুলের ফি নিবো না। হ স্যার নিয়্যাত করছি মাইয়াডারে শেস তামাত পড়াম। কিন্তু বাদশা মিয়ার পন বেশি দিন টিকে না। এরপর একমাত্র ছেলে রাকিব একেই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। সবার ছোট মেয়ে পারুল এখনো প্রাইমারির দোর পার করতে পারেনি।

বাদশা মিয়ার সংসারে অভাব অনাটন থাকলেও পারিবারিক বন্ধন অনেক ভালো। অন্য ভাই, প্রতিবেশি সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন বাদশা মিয়া। গ্রামের সবাই তাকে ভালোমানুষ হিসেবে জানে। ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সন্তানদেরকেও গড়তে চান তার মতো করে, কিন্তু সেটা দারিদ্রতার কারণে পেরে উঠেননি। ছেলেকে চেয়েছিলেন মাদরাসায় পড়াবে, কিন্তু কাছে কোন মাদরাসা না থাকায় সে ইচ্ছাকে বলি দিতে হয়েছে অঙ্কুরেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদশা মিয়া ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাইছেন।

এভাবে বাদশা মিয়ার দিন অতিবাহিত হচ্ছে, হঠাৎ একদিন গ্রামের নামকরা ঘটক ফারুক সরদার বাজারে বসে ডাক দিয়ে কই অ মেয়া মাইয়াতো স্যানা হইছে বিয়া দেয়া লাগবোনা? উত্তরে বাদশা মিয়া কই বিয়াতো দিমু, কিন্তু কাজলের মায় আরকেটু পড়াশোনা করাইতে চায়। মেট্রিক পাশটা কইরালোগ হ্যারপর না মাইয়ার বিয়ার চিন্তা করমু। ঘটক সাহেব কই হোনো মিয়া মাইয়া মানুষের পড়ালেহার দরকার কি? নিজের নামতো ল্যাখতে পারে, আর দিয়া কিহারবা? মাইয়া দিয়াতো চাকরি করাইবা না। হোনো তোমার ভালোর লাইগ্যা কই, আমার খোজে ভালো পোলা আছে বিদেশ থাহে। পোলার নাম হইছে সিরাজ বাবের নাম আইয়ূব আলী শেখ। সিকারপুরের শেখ বাড়ি, ঐ গ্রামে শেখ বাড়ি এক নামে চেনে। বাড়ির ঘরদুয়ারও ভালো। দ্যাহো তুমি চিন্তা কইরা। আমারে না হয় জানাইও আগামীকাইলকা।

বাদশা মিয়া ছেলে মেয়ের ঘুমের পর শেফালি বেগমের সাথে রাতে আলাপ করে মেয়ের বিয়া নিয়া। শেফালি বেগমের অমত থাকলেও সেটা বাদশা মিয়ার শোনার দরকার নাই। কারণ তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। সে সিদ্ধান্ত পাকা করে, পরের দিন বাজারে ঘটক ফারুক সরদারকে বলে ঠিক আছে মাইয়া বিয়া দিমু দেখতে আইতে কইয়েন। তাহলে আজকা বিকালেই ছেলে আর তাঁর দুলাভাই আইবে তোমার মাইয়া দ্যাখতে। আমাদের দেশে দুলাভাইয়রা বিশেষ করে শ্যালক এর বিয়া আসলে রাগের মৌসুম মনে করে। পান থকে চুন খসলেই রাগের পাহাড় মাথায় নিয়ে দুলাভাইরা চলে যায়। মুরব্বিদের বুঝাইয়া শুনাইয়া আনতে হয়। কেউ আবার বেশি রাগ করলে ফিরে আসেও না। নতুন বিবাহে ইচ্ছুক সিরাজ তাই দুলাভাইকে রাগ করার সুযোগ না দিয়ে, বিকাল বেলা তাঁর সাথে মেয়ে দেখতে নিয়ে যাবে সিদ্ধান্ত নেয়। বাদশা মিয়া কয় আচ্ছা আমনেও লগে আইয়েন। বাদশা মিয়া ঘটক কে ডাক দিয়ে বলে চা খাইয়া যান হরদার। ঘটক হাটাবস্থায় উত্তর দেয় আইজ আর না। বাড়িতে মেলা কাম পইরা রইছে। পোলাডাও বাড়ি নাই স্কুলে চইল্যা গেছে।

সিরাজ লিপিকে দেখতে এসে পছন্দ করে, সিরাজের দুলাভাইয়েরও শালা বউ হিসেবে লিপিকে পছন্দ হয়। ছেলের বাড়ি দেখে বাদশা মিয়ারও পছন্দ হয়। এরপর উভয় পক্ষ কথা বলে লিপির বিয়ের দিনখন ঠিক করে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয় জানুয়ারী মাসের ২৩ তারিখ শুক্রবার । আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের মতামত গুরত্ব পাইনা। বাবা অথবা মেয়ের অবিভাবক রাজি থাকলেই বিয়ে হয়ে যায়। লিপির ক্ষেত্রেও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। অমত থাকা সত্ত্বেও বাবার ইচ্ছায় দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে লিপিকে বিয়েতে রাজি হতে হলো।


বাদশা মিয়া মেয়েকে কিছুই দিতে পারেন নি। ছেলের পক্ষ থেকে ৫০ জন লোক এসে মেয়েকে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বাদশা মিয়া সিরাজের বাপকে বলে আজকে থেকে মাইয়া আপনার দেইখ্যা শুনে রাইখেন। লিপির সাথে তার খালাতো ভাই সজল ও তাঁর ছোট ভাই সাকিব গিয়েছে শ্বশুর বাড়ি। ছেলের মা নূর জাহান বেগম অনেক লোভী নারী। সে বউ বাড়িতে বরণ করে নেয় ঠিক, কিন্তু মনে মনে খুশি নন। কারণ লিপির বাবা মেয়েকে কিছুইযে দেয়নি। দুই তিন পরেই লিপিকে বিভিন্ন কটু কথা বলা শুরু করে।

বিয়ের পরদিন যখন কাজলের স্বামী রিপন ছোট ভায়রার বাড়িতে লেপ তোষক নিয়ে গেছে, কাজলের মা তখন বলে লেপ তোষক বিছাবে কোথায় একটা খাটও দিতে পারলো না এ আবার কেমন মেয়ের বাপ? আগুনে ঘি ঢালা কিছু মহিলা থাকে গ্রামে। সেই কোয়ালিটির এক প্রতিবেশি মহিলাও বলে আইজকালকি আগের যুগ আছে? কিছু না চাইলেওতো ছেলের ঘর হযাইয়া দেয়। না ভাবি আপনের ছেলের কপাল খারাপ, না হয় এমন শ্বশুর ভাগ্য জুটবে ক্যা। রিপন কথা শুনেও না শোনার ভান করে। লিপি কিন্তু ঘর থেকে কিন্তু সবেই শুনে।

বাবার বাড়িতে এসে লিপি সব কথা কেঁদে কেঁদে মায়ের কাছে বলে। মা সান্ত্বনা দিয়ে বলে কি করবি মা, আল্লায় গরিব বানাইছে মাইনষের কতা হোনোনের লাইগ্যা। বাদশা মিয়া এ খবর শুনে বলে কাঁদিস না মা। আমি তোর দুঃখ দূর করমু একটু সহ্য কর। বাবা মায়ের কাছে সবচেয়ে ভাড়ি বোঝা, সন্তানের অশ্রু রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর লিপি দ্বিতীয় বার শ্বশুর বাড়ি যায়। বাদশা মিয়ার একমাত্র সম্বল গাভি বিক্রি করে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির জন্য খাট, আলমিরা এবং সুকেশ ক্রয় করে। পৃথিবীর প্রত্যেক বাবারা চায় সন্তানের সুখ, সেটা নিজের শেষ সম্বল দিয়ে হলেও চেষ্টা চালিয়ে যায়। বাদশা মিয়াও তাই করলেন। ঠিকানা নিয়ে, লিপির ফোন নাম্বার ছোট কাগজে লিখে জামাই বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা করে বাূশা মিয়া। শেফালি বেগম শত চেষ্টা করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। কথাও মুখ দিয়ে বের হয়না, শুধু এই বলে বিদায় দিলো পৌছাইয়া ফোন দিও।

বাদশা মিয়া রওয়ানা করার কিছুক্ষণ পর লিপির কাছে ফোন আসে, ওপাশ থেকে বলে আপনি লিপি? লিপি উত্তর দেয় জ্বি, কে বলছেন? ঐ ব্যক্তি বলে আমাকে চিনবেন না, স্যামবর্ণ চেহারা, মুখে দাড়ি আছে মধ্য বয়সী লোক আপনার কি হয়? লিপি বলে আমার বাবা। ঐ ব্যক্তি বলে সে এক্সিডেন্ট করছে ট্রাক এর সাথে। কিছু সময় পর লিপি ফোন দিয়ে বাবার খবর জিজ্ঞেস করলে ঐ ব্যক্তি বলে দুঃখিত আপনার বাবা মারা গেছে। লিপি শুধু চিৎকার দিয়ে আব্বা বলে বেহুশ হয়ে যায়....

বাবাদের সংগ্রাম
মোঃ বিল্লাল হোসেন
মাদারীপুর সরকারি কলেজ, মাদারীপুর


বাবাদের সংগ্রাম || মু. বিল্লাল হোসেন বাবাদের সংগ্রাম || মু. বিল্লাল হোসেন Reviewed by pencil71 on August 21, 2022 Rating: 5

2 comments:

  1. মাশা আল্লাহ। অসাধারণ হয়েছে ভাই

    ReplyDelete
  2. অরিজিনাল গ্রামের পোলা। গ্রামের বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.