আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতির পাতা..!!
রোকেয়া বেগম
বাঁশবাগান
তখন ১৯৮৩ সাল । শীতের শুরুতে আব্বা আমাদের নতুন বাড়ি বানানোর কাজে হাত দিলেন। একটু একটু করে শীত বাড়ছে আর বাড়ির কাজও এগোচ্ছে। নতুন বাড়ির সাথে আমাদের জন্য ছিলো আরেকটি উপহার। বড়আপার প্রথম সন্তান, ফুটফুটে সুন্দর একটি ছেলে। এ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অনেক বড় উপহার । "তোমরা আল্লাহর কোন কোন নেয়ামত কে অস্বীকার করবে?"(সূরা আর রহমান)।
আমাদের বাড়িটা ৩ মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলো- পিছনে রয়ে গেলো অনেক স্মৃতি। আমি তখন অনেক ছোট। তখনকার স্মৃতিগুলো আমাকে এখন কাঁদায়।
আমাদের পুরাতন ঘরটা খুলে ফেলেছে। ঢেকির ঘরটাও নতুন বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। তখনো প্রতিবেশি চাচিরা ধান বানা এবং চালের গুড়ো করার জন্য আসছেন। মা তাদের সাথে এসব কাজের মাধ্যমে তাদের থেকে বিদায় নিচ্ছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। কারন অনেক বড় একটা সময় যাদের সাথে কাটিয়েছেন তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া বেদনাবিধুর। এ দুঃখের সাথে ছিলো আনন্দও। নতুন বাড়িতে নতুন অতিথি নিয়ে আমরা যখন উঠলাম শীত বাদে বসন্তও চলে গিয়ে গ্রীস্মের সৌন্দর্য তখন প্রকৃতিতে বিরাজমান। বাড়ির একধারে নদী ও আরেকধারে পুকুরের দক্ষিন পশ্চিম পার ঘেঁষে ছিলো ছোট্ট একটি বাঁশবাগান।
আমাদের ওই নতুন বাড়িতে যখন উঠলাম তখন সকাল থেকে সন্ধা রোদ খা খা করতো, ওই সময় সেই বাঁশবাগানের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া ছিলো না। গ্রীস্ম শেষে বর্ষা আসতে আসতেই আমার মা রকমারি ফলের গাছ লাগালেন। দেখতে দেখতে আমাদের বাড়িটা সুন্দর ছায়া ঘেরা একটি বাড়ি হয়ে গেলো। আমার মায়ের কলিজার টুকরা নাতি সহ আমার বড় আপা ও দুলাভাই ঢাকায় স্থায়ী হলেন। এক এক করে আমার তিন ভাইও পড়ালেখার সুবাদে ঢাকায় চলে গেলেন। নিরব-নিস্তব্দ হয়ে গেলো আমাদের সেই আনন্দমুখর বাড়িটা।
কোনো এক বর্ষায় টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে এরমধ্যে মা আমের বিচি লাগাবেন। আমাকে সাথে নিলেন, তখন মাকে আমের বিচি লাগাতে দেখে আব্বা বল্লেন - তোমার ছেলেরা তো আর বাড়িতে আসবেনা, এত গাছ বুনে কি হবে! তখন মা বল্লেন - "আমার ছেলেরা না আসলে মানুষে খাবে, পাখপাখালি খাবে আমার জন্য দোয়া করবে"।
ঠিক আমার মায়ের কথাই সত্য হয়েছে। আজ সেই টিনের ঘর ভেঙে দালান হয়েছে। সেই বাগান বাড়ির বাগান নানান জাতের ফলের গাছে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। ওই বাগানের ফল আত্নীয় -অনাত্মীয়, প্রতিবেশি, পাখপাখালি সবাই তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। তাই তো মনে পড়ে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদিসের বাণী "নিয়তের উপর নির্ভর করে নেক"।
আমার সেই তিন ভাই আজ বাড়িতে নেই। কিন্তু এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে আমাদের সেই ছোট্ট বাঁশ বাগান। আমরা কখনো বাড়িতে বেড়াতে গেলে বিদায়ের বেলা আমার মা এই বাঁশ বাগানের আড়ালে ততক্ষণ দাড়িয়ে কাঁদতে থাকতেন যতক্ষন আমাদের দেখতে পেতেন।
২২ বছর হলো আমার মা সেই বাঁশ বাগানের শীতল ছায়ায় মৃদু বাতাসে চির নিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন। সেখানে মায়ের সঙ্গী হয়েছে আমার বড় সন্তান, আমার শ্রদ্ধেয় আব্বা, আমার প্রিয় বড় ভাই।
"জেনে রাখো দুনিয়ার জীবনটা হলো খেল-তামাশা, চাকচিক্য, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধনমাল ও সন্তান -সন্ততির প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা। এর উপমা হলো বৃষ্টি, যার উৎপাদিত শষ্য কৃষকদের উৎফুল্ল করে। তারপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি দেকতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে, অবশেষে তা পরিনত হয় খড়কুটোয়। আর আখিরাতে রয়েছে কঠোর আযাব, মাগফিরাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। দুনিয়ার জীবনটা প্রতারনার সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়।" (সূরা আল হাদিদ, আয়াত-২০)।
আজ সে গান খুব মনে পরে......
আজ খুব পড়ছে মনে মাকে
মায়ার বাধনে রেখেছে আমাকে
স্নেহের ছায়ায় আমায় রেখে
যে মরণ শুধেছে....
তাই মহান আল্লাহর কাছে আকুতি করছি - "রব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়্যানি সগির"।
আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতির পাতা | রোকেয়া বেগম
Reviewed by pencil71
on
December 14, 2022
Rating:
No comments: