##_নিষিদ্ধ_পল্লী_##
০৬/০৪/২০১৮ইং
রায়হান সাদাত নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়!!! রায়হান সাদাত আখির স্বামী!!!!! না না এটা হতেই পারেনা। এটা অবিশ্বাস্য, কি করে সম্ভব? আখি নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিটা দেখে বারবার। আসলেই কি এটা রায়হানের ছবি? মানুষের ভীরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, ঐতো হালকা মেরুন রঙা হাফ শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা লোকটা, হ্যা হ্যা ওটা তো রায়হানই। আজ তো ওটা পরেই অফিসে গেছে সে। তবে কি রায়হান অফিসের কথা বলে ওখানেই গেছে? ছিছিছি..
ফেসবুকে একজন অতি উৎসাহী লোক এইমাত্র ছবিটা আপলোড করেছে। আপলোড করেছে এই কারণে যে নিষিদ্ধ পল্লীটা শহর থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রশাসন। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে বলে লোকটা এই উচ্ছেদের বিরোধী। সে লিখেছে- ‘উচ্ছেদ নয় পুনর্বাসন চাই’। স্ট্যাটাসের পাশাপাশি সে দিয়েছে নিষিদ্ধপল্লীর সদ্য তোলা এই ছবিটি। নিষিদ্ধপল্লীর প্রবেশ দ্বারের এ্ই ছবিতেই আখি আবিষ্কার করে তার স্বামী রায়হান সাদাতকে। ছবিতে রায়হান সাদাত দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। নিষিদ্ধ পল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে কোনো ভদ্রলোক এত নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট খেতে পারার কথা নয়। রায়হান খাচ্ছে। তার মানে কী? এ পাড়ায় রায়হানের অবাধ যাতায়ত আছে?
ঘটনাটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আখি অফিসে ফোন করে।
:হ্যালো, আমি মিসেস রায়হান বলছি..
:জ্বি জ্বি ভাবী বলুন।
:অনেকক্ষণ যাবৎ রায়হানকে ফোনে পাচ্ছিনা। ফোনটা সুইচট অফ।
:সেকি! রায়হান ভাই তো আজ একটু আর্লি বের হয়ে গেল অফিস থেকে। বাসায় ফেরেনি?
:না ফেরেনি।
:বলেন কি তাহলে তো ভাবনার কথাই। আচ্ছা ভাবি, আমি দেখি অফিসের অন্য কেউ কিছু জানে কিনা। টেনশন করবেন না। আমি কোনো খোঁজ পেলে নিশ্চয় জানাবো আপনাকে। এটাতো আপনারই নম্বর?
:জ্বি।
বখতিয়ার হোসেন অফিসের সবাইকে জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করে রায়হান কাউকে কিছু বলে গেছে কিনা। বখতিয়ার হোসেন নিশ্চিত হতে চায় রায়হান সুস্থ আছে। নিশ্চিত হতে চায় রায়হান রোড এক্সিডেন্ট করেনি, আহত কিংবা নিহতও হয়নি। কিন্তু বখতিয়ার হোসেন আশাহত হয়। সারা অফিস জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নতুন কোনো তথ্যই আবিষ্কার করতে পারে না। রায়হানের স্ত্রীকে তবে কি জানাবে বখতিয়ার, যাতে অন্তত আতঙ্কিত বেচারী আশ্বস্থ হবে। অগত্যা তার নিজের রুমে এসে ঝিম মেরে বসে থাকে সে।
ঠক ঠক ঠক…
বখতিয়ারের দরোজায় এসে দাঁড়ায় রিয়াজুল ইসলাম। সে এই অফিসের একজন ড্রাইভার কাম ম্যাসেনজার। রিয়াজুল দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকে কাচুমাচু করে।
:কিছু বলবে রিয়াজুল?
:জ্বি স্যার।
:এসো। ভিতরে এসো।
:একটা কথা স্যার বলতেও ভাল্লাগতাছে না, আবার না বললেও নিজেরে অপরাধী লাগতাছে।
:কোন্ কথাটা?
:না মানে স্যার..
:বলে ফেল রিয়াজুল। পেটের কথা বলে ফেললে হালকা লাগবে।
:মানে.. আমাগো রায়হান স্যার প্রায় প্রতিদিনই পতিতাপল্লীতে যায়। অফিস শেষে স্টাফদের গাড়িতে যাওয়ার সময় সবার শেষে নামে। আর নামে ঐ পল্লীর গেইটে।
:কী বল! না না, ওখানে নেমে হয়তো অন্য কোনো জায়গায় যায়।
:না স্যার। প্রথমদিন যাওয়ার সময় উনি আমারে জিজ্ঞাস করছিলো নিষিদ্ধপল্লীটা কোন্ জায়গায়। আমি দেহায়া দেওয়ার পর থাইকা এহন প্রায়ই ঐখানেই নামে।
:তাই নাকি! তা সেটা আগে আমাকে ইনফর্ম করবে না।
:সত্যি কথা কইতে কি.. রায়হান স্যার আমারে অনেক রিকোয়েষ্ট করছে আমি যেন এ বিষয়ে কাউরে কিছু না বলি। অনেক দিন নানান কিছু গিফটও করছে আমারে খুশী রাখার জন্যে।
:ছিছি কি বল!
বখতিয়ার হোসেন এক নতুন পরিচয়ের সন্ধান পায় রায়হানের। মনে মনে ভাবেন- শালা একটা বদমাশ। আচার আচরনে মনে হয় ধোয়া তুলসি পাতা, যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা, আর তলে তলে এত শয়তান! ওই শালাকে শয়তান বললে শয়তানকেও অপমান করা হবে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। কিন্তু ওর স্ত্রীকে এ কথা বললে কি বিশ্বাস করবে? না করুক, বিশ্বাস করা না করা তার ব্যাপার, বলাটা আমার দায়িত্ব।
:হালো ভাবি..
:জ্বি ভাই বলেন..
:কথাটা যে কিভাবে বলি… মানে কথাটা আমার কাছেই এখনো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
:বলুন না। আপনার কোনো সন্দেহ থাকলে বলতে পারেন, ধারনা করে থাকলেও বলতে পারেন আমি কিছুতেই কিছু মনে করবো না।
:আসলে হয়েছে কি…ধারনাটা ঠিক আমার নয়। মানে আমার অফিসের ড্রাইভার রিয়াজুল বললো রায়হান ভাই নাকি প্রতিদিন অফিস শেষে ব্রোথেল-এর গেটে নামে। প্লিজ এটা মনে করবেন না যে আমি ধারনা করছি উনি ব্রোথেলে যান। তবে নাকি প্রথম দিন রিয়াজুলকে ব্রোথেলের লোকেশনটা জিজ্ঞেস করেছিলেন রায়হান ভাই। আবার এটা যাতে কারোর সাথে শেয়ার না করে সেজন্যে নাকি নানান সময়ে নানা রকম গিফটও দেয় ওকে।
আর কিছু বলতে হয়না আখিকে। ফোন রেখেই সে ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করে। রায়হানের কিনে দেয়া কোনো কিছু্ নেবেনা সে। আখি গুছিয়ে নেয় সেই সমস্ত জিনিষ যেগুলো তার আত্নীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা তাকে নানান উপলক্ষ্যে গিফট করেছিল। আজ আর কোনোকিছুই থামাতে পারবেনা তাকে। বিকেলের ট্রেনে চড়ে সোজা চলে যাবে শ্রীমঙ্গল। কি পেয়েছে রায়হান! আখি কোনো বানের জলে ভেসে আসা মেয়ে নয়। যে রায়হানকে ভালোবেসে কেবলমাত্র ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মার কথার অবাধ্য হয়ে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিল সে রায়হানকে একমুহুর্তে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত আজ আখি। রায়হান আজ হারিয়ে ফেলেছে তার সকল নীতি নৈতিকতা। ছিছিছি আখি ভাবতেও পারছেনা এমন একটা মানুষের সাথে কিভাবে সে দু’বছর সংসার করে ফেলেছে? নিজের শরীর ছুঁতেও যেন ঘৃণা লাগছে নিজের। হঠাৎ সামনের টেবিলে থাকা রায়হান আখির ডুয়েট ছবিটা ফ্লোরে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে-
:শয়তান.. কুত্তা.. আমার সাথে এমন ফ্রডগিরি তুই কিভাবে করলি?
কুঝিকঝিক…কুঝিকঝিক…
ট্রেন ছেড়েছে যথাসময়েই। বাড়ি ফেরার বিগত সময়গুলোতে যত আনন্দ থাকতো আখির অন্তরে, আজ তার ছিটেফোটা নেই। আজ তার মন ভরে আছে লজ্জা গ্লানি আর হতাশায়। কি বলবে বাবাকে? মাকে? প্রতিবেশিদের? আত্নীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের? যদিও অপরাধী আখি নয়। অপরাধী রায়হান সাদাত। আখির অপরাধ কেবল রায়হানের মত একটা বদমাশকে জীবনসাথী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে। আখির লজ্জা রায়হানের মত একটা বিকৃত রুচির মানুষের সাথে দু’বছর একঘরে থেকেছে বলে। হঠাৎ আখির ইচ্ছা হয় মোবাইল করে রায়হানকে কিছু গালি দেয়। কিন্তু রিং করার পর দেখে মোবাইল বন্ধ-
:দিস মোবাইল ক্যান নট বি রিচ এট দা মোমেন্ট।
কি করবে আখি? ওর মনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো না পর্যন্ত অস্থির লাগছে ভীষন। ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসও গরম লাগছে যেন। সে ঘামতে থাকে দরদর করে। কি ভাববে পাশের যাত্রীটি? মেয়েটি অসুস্থ? নইলে সবার ঠান্ডা লাগছে আর সে জানালা খুলে রেখেও দরদর করে ঘামছে কেন? অনেক ভাবনা শেষে মোবাইলে একটা ম্যাসেজ লিখতে শুরু করে আখি-
:ওই কুত্তা, বেজন্মার বাচ্চা, ব্রোথেলে যাবি তাইলে আমারে বিয়া করছিলি ক্যান্? তোরে গালি দিতেও ঘিন্না লাগতোছে আমার। তুই একটা… তুই একটা… তুই জীবনেও আর আমার সামনে আসবিনা, আমি তোর চেহারা আর কোনোদিন দেখতে চাইনা। তোর বাসা ফাঁকা কইরা দিয়া গেলাম। এখন আর ওই সমস্ত জায়গায় না গিয়া বাসাতেই কল দিয়া সব করতে পারবি কুকুর।
আর বকতে ইচ্ছা হয়না আখির। রুচিও হয়না। ম্যাসেজটা সেন্ড করে ফোনটা সুইচট অফ করে দেয়।
ট্রেন চলছে কুঝিকঝিক কুঝিকঝিক।
:কেমন আছ আখি?
পাশের যাত্রী হঠাৎ কথা বলে ওঠে আখির সাথে। আখি খেয়ালই করেনি তার পাশে কে বসেছে। লোকটার কথায় সম্বিত ফিরে পায়-
:আরে… শহিদুল তুমি! তুমি কখন উঠলে?
:আমি তো সেই কখন উঠেছি, তুমি ওঠার পরপর। কিন্তু তুমি তো দেখছি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। পাশে একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ বসা সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নাই।
:আসলে হয়েছে কী…
:হয়েছে থাক। আর কোনো যুক্তি দেখাতে হবেনা। বুঝতে পেরেছি। কাছের মানুষকে দেখেও না দেখার যে আদি প্রবনতা তোমার ছিল, সেটা থেকে আজও মুক্ত হতে পারনি।
শহদুলের দেয়া খোঁচাটা আখি বুঝতে পারে। বুঝলেও না বোঝার ভান করে। আসলেই তো আখি তাই করেছে। Mohammad Sohidul Islam ছিল তার সহপাঠী, স্কুল জীবনের বন্ধু, কলেজেও একসাথে পড়েছে। শহিদুল আখিকে তার ভালোলাগার কথা নানাভাবে প্রকাশ করেছে, কিন্তু আখি কোনদিনই সেটা আমলে নেয়নি। কাছের মানুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেছে গ্রহণ করেছে দূর থেকে উড়ে আসা রায়হান সাদাতকে।
আখি আর ভাবতে চায়না রায়হানের কথা। তবুও কেন জানি স্মৃতিগুলো বারবারই এসে দাঁড়ায় আখির সামনে। জ্বালা পোড়া শুরু হয় আখির।
রায়হানের সাথে আখির পরিচয়টা শ্রীমঙ্গলেই। রায়হান তখন পোষ্টিং নিয়ে শ্রীমঙ্গলে। একটা এনজিওতে চাকরী করে। যাদের মূল কাজ চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোটিভেশনাল নাটক করানো। আখির বাবা চা বাগানের ম্যানেজার বলে রায়হান প্রায়শই যাতায়ত করতো আখিদের বাসায়। উদ্দেশ্য টি গার্ডেনের শ্রমিকদের নাটক দেখানোর পার্মিশন নেয়া।
:আসসালামু আলাইকুম ।
:ওয়ালাইকুম আস সালাম।
:ম্যানেজার স্যার কি আছেন?
:জ্বি না। বাবা ঘুমাচ্ছেন। কেন বলুনতো?
:আমি একটা এনজিওতে চাকরী করি। আমার কাজ চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোটিভেশনাল নাটক করানো।
:তাই নাকি!
:জ্বি। একটা নতুন নাটক তৈরী করেছি। ওটার টেকনিক্যাল শোতে স্যারকে ইনভাইট করতে এসেছিলাম। যদি সম্ভব হয়…
:আপনি কাগজে ডিটেইল ইনফরমেশন রেখে যান। বাবাকে আমি রাজি করাবো। এসব কালচারাল প্রোগ্রামে আমার আগ্রহ খুব।
:তাহলে তো খুব ভালো হয়। আপনিও আসুন না স্যারের সাথে। এখানে এই ইনভাইটেশন লেটারে সময়-তারিখ-লোকেশন সব লেখা আছে।এলে খুব খুশি হব।
:ওকে। ভালোকথা, আপনার নামটা জানতে পারি?
:আমি রায়হান সাদাত। আপনি?
:আমি আখি আক্তার।
অতটুকু পরিচয়েই রায়হানকে ভালো লাগে আখির। তাই রায়হানের নাটক দেখার আমন্ত্রণকে অগ্রাহ্য করতে পারেনা। উপরন্তু অতিউৎসাহ নিয়ে নাটক দেখতে যায়।
সন্ধ্যারাতে জ্বলে ওঠে হারিক্যান, কতিপয় মোমবাতি। লোক সমাগম হতে থাকে চা শ্রমিক নেতা বাবুসিংয়ের বাড়ির নিকোনো উঠোনে। বাবুসিংয়ের নির্দেশে চা শ্রমিক মীরা উপস্থিত দর্শকদের জন্যে নিয়ে উপস্থিত হয় সরিষার তেলে মাখানো মুড়ি। মুড়িতে মাখিয়ে দেয়া হয়েছে কচি চায়ের পাতা। আহা কি স্বাদ! আহা! একটা বিশেষ পাত্রে মাখানো মুড়ি পরিবেশন করা হয় আখির জন্যেও। ব্যস্ততার জন্যে ম্যানেজার বাবুর আসা হয়নি। কিন্তু আখির জন্য বিশেষ একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করতে ভোলেনি বাবুসিং।
নাটক শুরু হয়। বেজে ওঠে খোল মৃদঙ্গ। দূরে অন্ধকারে জোনাকিরাও নেচে চলে বাদ্যের তালে তালে।
আহারে চায়ের দেশ নাম শ্রীমঙ্গল,
চৌদিকে বাগান আর আছে এক জঙ্গল,
লাউরাছড়া জঙ্গলেতে আছে বণ্যপ্রাণি,
মাধবপুর লেকে পদ্ম করে কানাকানি।
আহারে বাগানেতে কত চা শ্রমিক,
মাথা কুইটা মরে ন্যায্য পায়না পারিশ্রমিক।
………
নাটক দেখে আখি প্রেমে পড়ে যায় রায়হানের। মোটিভেশনাল নাটকের সস্তা প্যানপ্যানানির বিপরীতে রায়হানের নাটকে আছে শিল্পের কারিশমা। ঐতিহ্যবাহী বাঙলা পালানাট্যের অপূর্ব উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে রায়হান চমৎকার মুন্সিয়ানায় ব্লেন্ডিং করেছে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানান টিপস। ব্রেভো রায়হান। ব্রেভো।
:হ্যালো, রায়হান সাহেব বলছেন।
:জ্বি জ্বি আমি রায়হান সাদাত। আপনার পরিচয়?
:আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার নাটক দেখলাম সেদিন।
:আপনার নামটা জানতে পারি?
:আমি আখি।
:ওহ সরি সরি। আমি খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। আসলে আমার বোঝা উচিত ছিলো। মানে আপনি ছাড়া এমন কোনো নারী তো আমার নাটক সেদিন দেখেনি যে কিনা রবিঠাকুরের লাবণ্যের কন্ঠে কথা বলতে পারে।
:বাহ বা। আপনি তো শুধু নাটক পরিচালনায় নয়, কথা বলাতেও বেশ পারদর্শী।
:আপনি যত সুন্দর করে কথা বলছেন, তার পাশাপাশি আমার কথা বলাটা ম্যাড়ম্যাড়া হলে কি আলাপ জমবে?
:তা অবশ্য ঠিক। আপনার কন্ঠস্বর সাবলীল না হলে, কথা বলা শুদ্ধ না হলে আমি দু লাইন কথা বলেই ফোনটা রেখে দিতাম।
:তাই নাকি! তা সে দুই লাইন নিশ্চয় এখনো বলা হয়নি। সে লাইন দুটো শুনতে পারি কি?
:আপনি অত্যন্ত গুনি মানুষ। আপনার নাটক আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে।
ট্রেন চলছে।পাল্লা দিয়ে চলছে আখির ভাবনারাও।
:এই.. ই.. পপকর্ণ চিপস চকলেট, পপকর্ণ চিপস চকলেট..
আখির ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন ট্রেনের ভেতর ঢুকে পড়ে হকার।
:আপা লাগবে কিছু?
:না না। কিছু লাগবে না। আচ্ছা, আমরা কোথায় এলাম শহিদুল?
:আখাউড়া জংশন। কিছু খাবে আখি?
:না না। ধন্যবাদ। কিছু খাবো না।
:একটা চা খেতে পার। চা খেলে তোমার ভাবনার ক্ষতি হবেনা। বরং চা খেলে ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। :সরি সরি। আমি সারাপথই বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলাম, তাইনা?
:তুমি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চলেছ নাকি?
:এটা বলছো কেন?
:না মনে হচ্ছে, এক জার্নিতে তুমি সারাবিশ্বের ভাবনা ভেবে ফেলছো। এতদিন পর দেখা হলো। কোথায় একটু কথাবার্তা বলবো। তা-না, মনে হচ্ছে আমাকে তুমি পুরোদমে ইগনোর করছো। কেন বলো তো?
:মনে কিছু নিও না শহিদুল। আসলে আমি একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
:ফ্যামেলি ক্রাইসিস?
:প্লিজ, আমাকে এ বিষয়ে আর প্রশ্ন করোনা কোনো।
শহিদুল দমে যায়। এ বিষয়ে ওদের কথা আর এগোয় না।
ট্রেন যখন শ্রীমঙ্গল পৌছায় তখন রাত একটা বেজে তেরো মিনিট। হাতঘড়িতে সময় দেখে আখি।বন্ধ করে রাখা মোবাইলটি তখনো বন্ধ্ আছে ওর। চাইলে মোবাইলটা ওপেন করে বাবাকে বলতে পারে কোনো লোক পাঠিয়ে ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু মোবাইলটাই আর ওপেন করতে ইচ্ছা হয়না আখির। মোবাইল ওপেন করলেই যদি ঐ শয়তান রায়হান তাকে ফোন করে। অথবা যদি তার গালি দেয়া ম্যাসেজের বাজে কোনো উত্তর দেয়। তাহলে তো মেজাজটাই চড়ে যাবে। আখি এখন সেটা চাচ্ছে না। এই রাতদুপুরে বাবা মার সামনে গিয়ে মেজাজ গরম করা একটা চেহারা দেখাতে ইচ্ছা হচ্ছে না ওর। এতদিন পর বাড়ি আসছে তার নিজের একটা দায়িত্ববোধ তো আছে। কেন হঠাৎ করে বাবা মাকে একটা টেনশনের মধ্যে ফেলে দেয়া। যা করতে হবে সব ভেবে চিনতে। ধীরে ধীরে। মনে রাখতে হবে তার বাবা মারও বয়স বেড়েছে। এমন একটা দুঃসংবাদ আকষ্মিক পেলে তাদের হার্টএটাকও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং বি কেয়ারফুল।
শহিদুল আর আখি একই সাথে রিক্সায় ওঠে। উদ্দেশ্য আখিকে বাসায় পৌছে দেয়া। রিক্সায় ওঠে আখি খেয়াল করে শহিদুল বসেছে মাঝখানে অনেকখানি জায়গা ফাঁকা রেখে। আখি মুচকি হাসে। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। আলো থেকে অন্ধকারের পথ ধরে এগোয় ওদের ত্রিচক্রযান। আখি বলে-
:বিয়ে করেছ শহিদুল?
:না। করা হয়নি। আর করবো কিনা জানিনা।
:কেন?
:একজনকেই ভালো লেগেছিল, ভালোও বেসেছিলাম তাকে। কিন্তু কেন জানিনা সে আমার হলো না, সে হয়ে গেল অন্যের।
:সে মানুষটা কি আমি?
শহিদুল কোনো কথা বলেনা আর।রাতের আঁধারে শহিদুলের চেহারা স্পষ্ট হবার কথা নয়। যদিও আখি তাকে স্পষ্টতই দেখে।শহিদুলের মন খারাপ।
:হাতখানি দেবে শহিদুল
:হাত? মানে হাত!
:হুমম তোমার হাতটা।
শহিদুল কিছু না বোঝে হাতটা বাগিয়ে দেয়।
:আমি খুব ভালো নেই শহিদুল।আচ্ছা, আমি যদি কখনো চাই, তুমি কি তোমার হাতের স্পর্শে আমার মনের কষ্ট দূর করে দিতে পারবে?
শহিদুল কোনা কথা বলে না। আখি ধরে নেয় শহিদুলের নিরবতার মাঝে আছে সম্মতির ইশারা।
চা বাগানটির মাঝে আছে কিছু বিদ্যুতের খুঁটি। এখানে সেখানে আলো জ্বলছে বিশেষত আখিদের বাংলোটিকে ঘিরে। গেটে এসে দাঁড়ায় রিক্সা। দারোয়ান এগিয়ে এসে ব্যাগ ধরে আখির। এই মধ্যরাতেও জেগে আছে সে। শহিদুল বলে-
:আমি তবে যাই আখি। এখন যেতে পারবে তো?
:হ্যা হ্যা পারবো। অনেক ধন্যবাদ।
:ইটস ওকে। কয়েকদিন আছ তো?
:হুমম আছি।
:তাহলে ফোন করবো। দেখা হবে।
:ওকে।
মধ্যরাতে আখিকে দেখে বাবা মা ভীষন সারপ্রাইজড।
:কিরে জামাই আসেনি?
:না আমি একাই এসেছি।
:কতদিন পর এলি। জামাইকেও নিয়ে আসতে পারতি।
:ও খুব ব্যস্ত।
:তুই তো অনেক শুকিয়ে গেছিস। সংসারে খুব টানাটানি তাইনারে?
:আহা মাহফুজা, মেয়েটা আসতে না আসতেই এসব কি আলোচনা শুরু করলে। যাতো মা হাত মুখ ধুয়ে নে।
আখি ডাইনিং টেবিলের পাশের বেসিনে দাঁড়িয়ে মুখে পানি ছিটায়।
:শোনো মাহফুজা, মেয়েটা সারাপথ জার্নি করে ক্লান্ত। নিশ্চয় ক্ষুধার্তও। যাও দেখ খাবার কি আছে। তা হ্যারে মা, আমাকে তো একটা ফোন করলেই পারতি। স্টেশনে গাড়ি পাঠাতাম।
:ইচ্ছা করেই করিনি বাবা। এত রাতে তোমাদের বিরক্ত করিনি। তাছাড়া সাথে আমার স্কুল ফ্রেন্ড শহিদুল ও ছিল। ওই-ই পৌছে দিয়ে গেল বাসায়।
:তাই নাকি!
:হুমম।
খেতে ইচ্ছা করছিল না আখির। তবুও খেতে হলো পাছে বাবা মা টের পেয়ে যায় সেই ভয়ে। মাহফুজা খাতুনের রান্নার সুখ্যাতি আছে পুরো ফ্যামেলিতে। আখিও মায়ের রান্না খুব পছন্দ। বিশেষ করে মাছ রান্নাতে তিনি স্পেশালিষ্ট। আখি মায়ের হাতের রা্ন্না খায় এবং খাওয়ার শেষে হাতও চাটে। এ অভ্যাস আখির সেই ছোটবেলা থেকে। মেয়ের পাশে বসে এমন তৃপ্তির খাওয়া দেখতে বেশ লাগে মাহফুজা খাতুনের। কিন্তু আজকের খাওয়াটিতে তিনি আখির মাঝে সেই তৃপ্তিকর অভিব্যাক্তির অনুপস্থিতি টের পান।
:কিরে তরকারী ভালো লাগছে না?
:না না মা ঠিক আছে। খুবই মজা হয়েছে।
:তাহলে আরেক পিস নে। শুকনা করে খাচ্ছিস কেন? তোর প্রিয় মাছ পাবদা বলেই ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করলাম।
:তুমি তো জানই মা রাতে আমি কম খাই। তাছাড়া মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। এখন খাওয়া মানেই ভুড়ি বাড়ানো, খাওয়াটাতো বার্ণ হবে না।
:হয়েছে হয়েছে। বাসায় এসেই ডায়েটিং শুরু করতে হবে না। যে ক’দিন আছিস তৃপ্তি সহ খাবি।
:ঠিক আছে, ঠিক আছে। তবে দাও আরেক পিস।
মাহফুজা খুশি হন মেয়ের কথায়। মাছ উঠিয়ে দেন মেয়ের প্লেটে। মেয়ে খুশি হয়না। আচরণ কিছুটা যন্ত্রবৎ।
:তোকে খুব অন্যমনস্ক লাগছে। কোনো সমস্যা নাতো? মানে জামাইয়ের সাথে।
:আরে না না। কিযে বলনা মা। জার্নি করে এসেছি তো। সেজন্যে হয়তো ক্লান্ত লাগছে।
:যাক সমস্যা না হলেই ভালো।
আখি তার সমস্যার কথা এখনি বাবা মাকে বলতে রাজি নয়।তাই চেপে যায়।
রাতে আর ঘুম আসেনা আখির। মধ্যরাত পেরিয়েছে সেই কখন। রাত এখন শেষ রাতের যাত্রাপথে। রায়হানের প্রতি ক্ষোভে যেন গা কাঁপে আখির। সে হয়ে ওঠে প্রতিশোধপ্রবণ।তার এই প্রতিশোধের প্রথম ধাপ শুরু হবে শহিদুলকে দিয়ে। কেন জানি মনে হচ্ছে এখনো জেগে আছে শহিদুল। ওকে ফোন করা দরকার। কিন্তু মোবাইলটা তো সুইচট অফ। রাহাতের সাথে কথা বলতে হলে খুলতেই হবে মোবাইলটাকে।খুলবে কি মোবাইলটা?
আখি মোবাইলটা অন করে। মোবাইল খোলার সাথে সাথে বেজে ওঠে ম্যাসেজ এলার্ট। রায়হান পাঠিয়েছে ম্যাসেজ। নিশ্চয় আখির পাঠানো ম্যাসেজের উত্তর। একবার ভাবে ম্যাসেজটা না পড়েই শহিদুলকে ফোন করবে সে। কারণ রায়হান নিশ্চয় এমন কিছু লিখে পাঠিয়েছে যাতে মেজাজটাই বিগড়ে যাবে। আবার ভাবে অন্য কিছুও তো হতে পারে, দেখা যাক না। শেষ পর্যন্ত রায়হানই জয়ী হয়। আখি শহিদুলকে ফোন করার আগে খুলে বসে রায়হানের ম্যাসেজ।
:অস্বীকার করবো না আখি, আমি প্রায় প্রতিদিনই ব্রোথেলে গেছি। প্রায় প্রতিদিনই অফিস শেষে তোমাকে না জানিয়ে থেকে এসেছি ব্রোথেলের বদ্ধ কুঠরিতে। কাটিয়ে এসেছি অনেকটা সময়।
তবে সবার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলোনা। সবাই যে কারণে যায়, আমি ঠিক সে কারণে যাইনি সেখানে। তবুও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে যাও। তোমাকে ফেরাবো সে সাহস আমার নেই। কারণ আমি তোমার সাথেআমার সত্য পরিচয় গোপন করেছি। অথবা পাশ কাটিয়ে গেছি কিছু চরমতম সত্যকে। আজ শুধু সেটুকু বলবো বলেই এই ম্যাসেজ লিখছি।
এতদিন বলিনি, বলিনি লজ্জায়, বলিনি আতঙ্কে, আজ বলি। আসলে আমার মা একজন পতিতা। থাকতেন ব্রোথেলে। এই জেলায়। আমাকে ছোটবেলা থেকে বাইরে রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। নিজে পরিশ্রম করেছেন, কষ্ট সয়েছেন। কিন্তু আমাকে রেখেছেন জৌলুসে। সবসময় চাইতেন তার কোনো পাপ যেন আমাকে স্পর্শ না করে। চাইতেন আমার বেড়ে উঠবার পথ যেন মসৃণ থাকে। সে জন্যে তাকে করতে হয়েছে কঠোর অধ্যাবসায়। তার শ্রমে ঘামে আর নিজেকে বিসর্জনের মাধ্যমেই আজকের আমার বেড়ে ওঠা।
মাকে বলেছিলাম- তুমি ও পথ ছেড়ে চলে আস, থাক আমার সাথে। মা বলেছিলেন-বাছা, ব্রোথেলের বাইরে গেলে নিজেরে বড় অসহায় লাগে, কারোর চোখের দিকে তাকাতে পারিনা। তাছাড়া এখানে চুনি আছে, ফারিয়া আছে, মালতি আছে, মায়া আছে, ওরাও তো আমার কণ্যাতূল্য, নিজের সুখের কথা ভেবে ওদের ফেলে রেখে কিভাবে যাই? মা আমার আসেনি স্বাভাবিক জীবনে। আমিও ব্যস্ত হয়ে যাই আমার ক্যারিয়ার নিয়ে।
ভিন্ন জেলায় চাকরী করেছি বলে দীর্ঘদিন দেখা স্বাক্ষাৎ ছিলো না মায়ের সাথে। এখানে বদলি হয়ে এসে আমি তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ভীষন অসুস্থ আমার মা। রোগে ভুগে অসুস্থ এক মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ। তারপর পাল্টে যায় আমার স্বাভাবিক চলনবলন। প্রায় নিয়মিতভাবেই আমি আসতে থাকি ব্রোথেলে। আসলে ঠিক ব্রোথেলে নয়, আসতে থাকি আমার মায়ের কাছে। অফিস শেষেই ছুটে চলে আসতাম। আমার এ পরিচয়টা তোমার অজানা ছিল বলে তোমাকে বলার সাহস পাইনি।
অবশেষে মা আমার মারা যায় আজ। ফোনটা বন্ধ করে আমি নেমে পড়ি দাফন কাফনের কাজে। ফোন বন্ধ করেছিলাম, কারণ আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত ছিল, তুমি প্রশ্ন করলে কি বলতাম আমি তোমাকে?
তুমি ভালো থেকো। জানি, পতিতার সন্তান পরিচয় জানার পর আমাকে আর স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে না তুমি।
আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা করো আমার সত্যিকারের পরিচয়টি তোমার কাছে গোপনে রেখেছিলাম বলে।
ইতি
রায়হান
আখির গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। কি বলছে রায়হান! কেন সে এতদিন এত কথা পুষে রেখেছিল ওর মনের গভীরে? আখির চোখ ভিজে যায় জলে। এমন এক পরিস্থিতির মুখে সে পড়বে এটা তার কল্পনাতেও ছিলনা। কি করবে সে এখন? কি করা উচিৎ তার? সে বুঝে উঠতে পারেনা। রুমের বাইরে বেরিয়ে এসে বসে বারান্দার চেয়ারে। কেবলি অন্ধকার, শুনশান নিরবতা। হঠাৎ শুনতে পায় চা শ্রমিক বস্তিতে মাতাল এক শ্রমিক তখনো উদাস সুরে গেয়ে চলেছে হেরে গলার ধামাইল গান-
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি, মধ্যে মধ্যে ছেদা
নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, কলঙ্কিনী রাধা ॥
কোন বা ঝাড়ের বাঁশের বাঁশি, ঝাড়ের লাগাল পাই।
জড়ে পেড়ে উগরাইয়া, সায়রে ভাসাই ॥
আখির আর ফোন করা হয়না শহিদুলকে। বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে আবারও ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। কাল ভোরেই আবার তাকে রওনা দিতে হবে ফিরতি ট্রেনে।
তরুন লেখক; জহির রায়হান
নিষিদ্ধ পল্লীর গল্প-মু.জহির রায়হান---Pencil71
Reviewed by pencil71
on
April 06, 2018
Rating:

valoi hoyece...
ReplyDelete